২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এনটিআরসিএ শিক্ষক নিয়োগ : কী হচ্ছে নেপথ্যে?

এনটিআরসিএ শিক্ষক নিয়োগ : কী হচ্ছে নেপথ্যে? - ছবি : সংগৃহীত

বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের আবেদন সম্পন্ন করেছে এনটিআরসিএ। ১৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে অনলাইনে সহকারী শিক্ষকের শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন কার্যক্রম।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়ায় দেশ যখন ভাসছে, ঠিক তখনই চলে অনলাইনে আবেদন কার্যক্রম। অপপ্রচার ও গুজব বন্ধে বিটিআরসি ওই সময় দু’দিন ইন্টারনেট স্পিড কমিয়ে আনে। এক রকম ইন্টারনেটের সাথে যুদ্ধ করেই নিবন্ধনধারীদের আবেদন করতে হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক নেয়ার কথা।


এনটিআরসিএ’র তথ্য মতে, সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০ লাখ নিবন্ধনধারী আাবেদন করেছেন। ওই হিসাবে, একটি শূন্যপদের বিপরিতে ৭৫ প্রার্থী আবেদন করেছেন। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে নির্বাচিত প্রার্থীদের জানিয়ে দেয়ার কথা, কে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।

ভাবছেন সবই তো দেখছি ঠিক আছে, তাহলে সমস্যা কোথায়? বিস্তারিত আলোচনায় বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এনটিআরসিএ এ পর্যন্ত ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। এ পর্যন্ত এনটিআরসিএ কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। যখন প্রথম থেকে ১২তম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ ২০১৮ সালের পরে মেয়াদোত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়; তখন বঞ্চিত নিবন্ধিত শিক্ষকেরা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রায় ২০০টি মামলা করেন। আদালত ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ১৬৬টি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় দেন। এনটিআরসিএ’কে সাতটি নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। নির্দেশনাগুলো হলো-

১. এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে সনদের মেয়াদ নির্ধারণ না করেই সার্টিফিকেট ইস্যু করবে এবং যারা একই উদ্দেশে সনদ অর্জন করবেন, তাদের নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সনদের মেয়াদ বহাল থাকবে। 
২. এ আদেশ প্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে এনটিআরসিএ’কে একটি মেধা তালিকা করার নির্দেশ করা হচ্ছে এবং এনটিআরসিএ’র অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যেন মেধাতালিকা এবং পজিশন দেখতে পারেন আবেদনকারীরা।

৩. শুধু একটি মেধাতালিকা থাকবে, এনটিআরসিএর উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগভিত্তিক কোনো মেধা তালিকা হবে না এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকা থেকে দেয়া হবে।

৪. এনটিআরসিএ সর্বশেষ একটি নিয়োগ সম্পন্ন করে বছরে একবার সম্মিলিত মেধা তালিকা আপডেট করবে। 
৫. এনটিআরসিএ’কে জাতীয় মেধা তালিকা অনুসারে রিট পিটিশনার ও প্রত্যাশিত আবেদনকারীর নাম; যাদের সনদ ইস্যু করা হয়েছেÑ তাদের নিয়োগ দেয়ার জন্য সুপারিশ করতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এবং নিয়োগের পর শিক্ষামন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষাবোর্ড নিয়োগকৃত শিক্ষকদের আবেদনে নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে বদলির অনুমতি দিতে পারে।

৬. এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি যদি কার্যকর না করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ড ওই কমিটি ভেঙে দেবে এবং ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। 
সর্বশেষ ৭. চাকরির এন্ট্রি প্রসেসে যেহেতু কোনো বয়স নির্ধারণ নেই, সেহেতু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রার্থীদের বয়সসীমা করতে সরকারের একটি জরুরি পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

আদালতের দেয়া উল্লিখিত সাতটি নির্দেশনার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান যে নির্দেশনা তা-ই অমান্য করেছে এনটিআরসিএ। আদেশ অনুযায়ী, প্রথমে প্রথম থেকে ১৪তম নিবন্ধিতদের নিয়োগ সুপারিশ সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু সেখানে তা না করেই পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। উপরন্তু ওই বিজ্ঞপ্তিতে বয়স নিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়। অর্থাৎ, বিজ্ঞপ্তি অনুসারে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থীরা শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদনসহ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সনদ অর্জন করবেন। কিন্তু এমপিও নীতিমালা অনুসারে, গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন কিংবা পরবর্তীতে এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থী যদি সনদ অর্জন করে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ না পান, কিংবা নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্ত না হন; তা হলে তার ওই সনদের কী মূল্য থাকে?

শিক্ষক নিবন্ধন সনদ মূলত শিক্ষকতার একটি পেশাগত সনদ। শিক্ষকতা ছাড়া এ সনদের কোনো মূল্য নেই। যদি এ সনদ অর্জন করে বাতিল হয়ে যায়, তা হলে এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুস্পষ্ট বিধি-নিষেধ আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা না করে প্রতিষ্ঠানটির বয়স নিয়ে এরকম লুকোচুরির অর্থ কী। যদি পূর্ণাঙ্গ রায় অনুসরণ করা হয়, তাহলে গণবিজ্ঞপ্তিতে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থীদের আবেদনের সুযোগ থাকার কথা। সম্প্রতি প্রকাশিত হয় ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধিতদের ফল। তারা এখনো সনদ পাননি। কিন্তু তাদের মধ্যে পঁয়ত্রিশোর্র্ধ্ব সনদধারীরা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করে নীতিমালার কারণে বাদ পড়ছেন। বিষয়টি অমানবিক। হাইকোর্টের নির্দেশিত সাতটি পয়েন্টই অনুসরণীয়। পঁয়ত্রিশোর্র্ধ্ব নিবন্ধিত শিক্ষকেরা অধিকার ফিরে পেতে ফের আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।

অন্য দিকে নিবন্ধনধারী বেকার যুবকদের কাছ থেকে এনটিআরসিএ তুলেছে কোটি কোটি টাকা। ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে; এখানে এনটিআরসিএ’র মতে, ৩০ লাখ আবেদন জমা পড়েছে। প্রতি আবেদনের বিপরীতে এনটিআরসিএ আবেদনকারীদের কাছ থেকে নিয়েছে ১৮০ টাকা করে। তা হলে এনটিআরসিএ আবেদনকারীদের কাছে থেকে টাকা পেয়েছে (৩০ লাখ * ১৮০) ৫৪ কোটি টাকা। এনটিআরসিএ ১৮০ টাকা করে নিলেও নিবন্ধনধারীদের কিন্তু আরো অতিরিক্ত ৪০-৫০ টাকা করে গুনতে হয়েছে;

যা কম্পিউটার অপারেটররা নিয়েছেন। এনটিআরসিএ এখানে বেকারদের সাথে বড় অন্যায় যেটি করেছে; তা হলো প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন করতে বাধ্য করা এবং প্রতি আবেদনে ১৮০ টাকা করে নেয়া। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের এ যুগে কেন এবং ঠিক কোন যুক্তিতে একজন বেকারকে একই বিষয়ে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে ১৮০ টাকা দিয়ে আবেদন করতে হবে? যেখানে প্রত্যেক নিবন্ধনধারীর জাতীয় মেধা তালিকা করা হয়েছে। বিষয়টি বোধগম্য নয়। প্রতিটি আবেদনের বিপরীতে টাকা নেয়ার বিষয় উল্লেখ করে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান একটি বিশেষ নোটিশে বলেছেন, বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থীকে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়। আর নিবন্ধনধারীদের মাত্র ১৮০ টাকা ফি।

তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক, ১৮০ টাকা, কিন্তু সেটা তো একবার নয়। একবারে যদি এক হাজার বা দুই হাজার করা হতো, তা হলে বেকারদের আপত্তি থাকত না। এতে একদিকে নিবন্ধনধারী যুবকদের টাকাও অনেক কম লাগত, অন্য দিকে সময়ও বাঁচত। তা ছাড়া একজন নিবন্ধনধারীর কাছ থেকে একটিমাত্র আবেদন এলে খুব সহজেই মেধা তালিকা অনুযায়ী প্রার্থীর নির্বাচিত স্কুল-কলেজের বাছাইপর্ব শেষ করা যেত। এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।

একাধিক আবেদনের নিয়মে প্রকৃত মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত নাও হতে পারেন। ধরা যাক, একজন নিবন্ধনধারী ৮০ নম্বর পেয়েছেন। কিন্তু তিনি বেশি স্কুলে আবেদন না করায় কোনোটাতেই নির্বাচিত হলেন না। অন্য দিকে ৫০ নম্বর পেয়েও বেশি স্কুলে আবেদনের কারণে অনেকে নির্বাচিত হলেন। তা হলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? এতে মেধাবীরা জয়ী হবেন; নাকি মেধাহীনরা তা বলা মুশকিল। 
লেখক : সাংবাদিক 

sulaymansir87@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement